Picture of SuperAdmin

SuperAdmin

Video Editor

শিক্ষা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের প্রভাব: ইতিবাচক দিক ও চ্যালেঞ্জ

শিক্ষা খাতে উন্নয়ন একটি জাতির অগ্রগতির অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। উন্নত ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণও অনেক দেশেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশেও শিক্ষা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চলছে। তবে এই অংশীদারিত্ব যেমন কিছু ইতিবাচক দিক নিয়ে এসেছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। এই লেখায় আমরা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ঢাকার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি মাধ্যমিক স্কুলের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। স্কুলটির অবস্থা বেশ নাজুক ছিল, কেননা তাদের যথাযথ অবকাঠামো ও শিক্ষকের অভাব ছিল। ২০১৮ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই স্কুলে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিষ্ঠানটি স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণ করে, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করে এবং শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ফলে স্কুলটি প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী উত্তীর্ণের হার থেকে ৯০%-এর উপরে উন্নীত হয়। 

এই ঘটনা আমাদের দেখায়, কীভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন সম্ভব এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারে।

শিক্ষা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: ইতিবাচক দিকসমূহ

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল:

১. অবকাঠামোগত উন্নয়ন: অনেক সরকারি বিদ্যালয়ের নিজস্ব অবকাঠামো দুর্বল এবং যথাযথ সংস্কারের অভাব রয়েছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে এ ধরনের বিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক ক্লাসরুম, টয়লেট, পানীয় জলের ব্যবস্থা এবং ল্যাব স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “ব্র্যাক” ও “অ্যামাজন” এর মতো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে।

২. শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন: অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আধুনিক শিক্ষাদানে দক্ষ করে তুলেছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ কর্মশালা, ট্রেনিং প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক।

৩. উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার: অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ, কম্পিউটার ল্যাব এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এই ধরনের সুবিধার কারণে শিক্ষার্থীরা আরও আকর্ষণীয় ও কার্যকর উপায়ে শিখতে পারছে।

৪. অর্থায়নের সুবিধা: সরকার সাধারণত শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন দিতে হিমশিম খায়। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠেছে, যা শিক্ষার বিস্তারে প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব পূরণ করতে সহায়তা করছে।

৫. উদ্ভাবনী শিক্ষাপদ্ধতির প্রয়োগ: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বিদ্যালয়গুলোতে উদ্ভাবনী শিক্ষাপদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে। যেমন, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষা, এবং আধুনিক ইন্টারেক্টিভ শেখানোর কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে শিক্ষার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি সাফল্যের উদাহরণ রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বিদ্যালয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা হয়েছে, সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার প্রায় ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, ব্র্যাকের “শিক্ষা সহায়তা প্রকল্প” বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি শিশু উপকৃত হয়েছে। 

চ্যালেঞ্জসমূহ

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে সমস্যাগুলো

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন সাধিত হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যা এই উদ্যোগের সফলতা প্রভাবিত করতে পারে। 

১. স্বার্থের সংঘাত: অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করতে চায়, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। কিছু প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য থাকে লাভ করা, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে।

২. যোগ্য শিক্ষকদের অভাব: কিছু ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ফলে বিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগে সমস্যা দেখা দেয়। বেসরকারি খাতে উচ্চ বেতনভাতা দেওয়ার ফলে সরকারি বিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষক চাকরি ছেড়ে বেসরকারি বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ফলে সরকারি বিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকের অভাব তৈরি হয়।

৩. সামাজিক বৈষম্য: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উন্নত শিক্ষা কেবল শহরের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য হতে পারে, যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এতে শহর ও গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ে।

৪. স্বচ্ছতার অভাব: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে অনেক সময় পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা না থাকার কারণে প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাবে ৩৫% অর্থ সঠিকভাবে খরচ হয় না।

৫. দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের অভাব: অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেবল সাময়িক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এর ফলে শিক্ষাপ্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, যা শিক্ষার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

ভবিষ্যতের করণীয়: 

অংশীদারিত্ব আরও কার্যকর করার উপায়

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব আরও কার্যকর করতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো:

১. স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন: অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নে স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

২. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: শিক্ষাখাতে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান টেকসইভাবে উন্নত করা যায়।

৩. যোগ্য শিক্ষক নিশ্চিত করা: সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বেসরকারি খাতে শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. সমাজের সব স্তরের জন্য সুযোগ তৈরি: শিক্ষা সুযোগের বৈষম্য কমানোর জন্য শহর ও গ্রামীণ এলাকায় সমানভাবে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সমাজের সব স্তরের শিক্ষার্থীরা সমান সুযোগ পায়।

৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পরিবর্তে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তাদের মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তা দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এর সফলতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং উভয় পক্ষের জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যদি এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব আরও কার্যকর করা যায়, তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত ও স্থায়ীভাবে সমৃদ্ধ হতে পারবে। শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমেই শিক্ষার ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে।

May you like -----