Picture of SuperAdmin

SuperAdmin

Video Editor

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন: পরীক্ষামূলক থেকে দক্ষতামূলক শিক্ষায় রূপান্তর

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের রীতি হলো পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধার মাপকাঠি নির্ধারণ করা। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান মূল্যায়নের প্রধান উপায় হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে পরীক্ষাকেই নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে। তবে বর্তমান যুগে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা এবং দক্ষতা মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আজকের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শিক্ষার্থীদের কেবল তথ্য মুখস্থ করেই সফলতা অর্জন সম্ভব নয়; বরং তাদের প্রয়োজন প্রকৃত দক্ষতা অর্জন। তাই, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে দক্ষতামূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এখন অনস্বীকার্য।

বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা

আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কেবল পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। পরীক্ষায় কতটুকু তথ্য মুখস্থ করা হয়েছে এবং তা কত দ্রুত উত্তরপত্রে লিখতে পেরেছে—এসবই মূল্যায়নের মূল বিষয়বস্তু। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় জ্ঞান অর্জন না করেই ভাল ফলাফল করতে পারে, যা প্রকৃত দক্ষতা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, নবম শ্রেণীর ছাত্র শাহিন গণিতে ভালো নম্বর পেয়েছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সে সাধারণ হিসাব করতে পারে না। এমন ফলাফল শিক্ষার প্রকৃত মান বজায় রাখতে ব্যর্থ।

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কেবল পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে নয়, বরং তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর এবং ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জনকে প্রধান গুরুত্ব দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের একটি বিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত প্রকল্প ভিত্তিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে, যেখানে তারা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। ফলাফলস্বরূপ, তাদের শিক্ষার্থীরা দক্ষতায় সমৃদ্ধ এবং কর্মক্ষেত্রে সহজে মানিয়ে নিতে সক্ষম।

বাংলাদেশে দক্ষতামূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্বের অন্যতম কারণ দক্ষতার অভাব। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থীই চাকরির বাজারে টিকে থাকার মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বেকার যুবকদের মধ্যে প্রায় ৬০% এর বেশি প্রযুক্তিগত এবং যোগাযোগ দক্ষতার অভাবে চাকরির সুযোগ হারাচ্ছে। এর ফলে, শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন নয়, বরং দক্ষতার মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

দক্ষতামূলক শিক্ষার বিভিন্ন উপায়

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হলো:

১. প্রকল্প ভিত্তিক শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতে দিলে তাদের বিশ্লেষণ এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, একাদশ শ্রেণীর একটি বায়োলজি ক্লাসে শিক্ষার্থীরা যদি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে, তবে তা তাদের বাস্তব জীবনে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করবে।

২. ইন্টার্নশিপ ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ: শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনেই ইন্টার্নশিপ বা প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করা হয়, যাতে তারা কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারে।

৩. আন্তঃবিষয়ক শিক্ষা: শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের উপর নির্ভর না করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করা উচিত। এভাবে তাদের মনের দিগন্ত প্রসারিত হয় এবং তারা বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।

৪.দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার সুফল : দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি কেবল পরীক্ষায় নম্বর বাড়ায় না, বরং শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো বিকাশে সহায়তা করে। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা যেমন উন্নত কৌশল ও সমস্যা সমাধানে পারদর্শী হয়, তেমনি তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। এভাবে দক্ষতায় সমৃদ্ধ শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

পরীক্ষামূলক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় রূপান্তর আজ সময়ের দাবি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল তথ্য মুখস্থ না করে, বরং সেই জ্ঞানকে দক্ষতায় রূপান্তর করতে পারে। তাই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর না করে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা উচিত।

May you like -----