একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার উন্নতির মূল ভিত্তি, এবং এই ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ হল শিক্ষক। দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের মেধা ও নৈতিক বিকাশে সহায়তা করে থাকে। তবে, শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতি আনতে হলে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ রয়েছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করছে।
বাংলাদেশের শিক্ষকদের বর্তমান প্রশিক্ষণ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে অনেক শিক্ষকেরই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, যা শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৭০% স্কুলশিক্ষকই মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। বিশেষ করে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। দেশের প্রায় ৬০% শিক্ষক প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতা না থাকায় ই-লার্নিং বা প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দুর্বল। এ কারণে শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞান থেকে পিছিয়ে পড়ছে এবং শিক্ষার গুণগত মানে ভাটার টান পড়ছে।
উদাহরণ: একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের অভিজ্ঞতা
মৌসুমী, রাজশাহীর একটি গ্রামের স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষিকা। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন, তবে কেবলমাত্র মৌলিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। যখন করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস শুরু হলো, মৌসুমীর কাছে এ প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছিল না এবং তার ক্লাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর তিনি সরকারের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এখন তিনি অনলাইনে শিক্ষাদান দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে সক্ষম। এই গল্পটি বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় উন্নতি আনে।
শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও এর প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে তিনটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে:
১. ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি: শিক্ষকদের দক্ষ ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং তাদের মধ্যে শিক্ষা আগ্রহ জাগাতে শিক্ষকদের দক্ষতার প্রয়োজন।
২. ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা: বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া শিক্ষাদান সম্পূর্ণ হতে পারে না। শিক্ষকদের ডিজিটাল দক্ষতার উন্নতি করতে হবে যাতে তারা ই-লার্নিংয়ের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও সরঞ্জাম সহজে ব্যবহার করতে পারেন।
৩. আচরণগত দক্ষতা ও মানসিক সহায়তা: শিক্ষার্থীদের নানাবিধ মানসিক ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় শিক্ষকদের মানসিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শিক্ষকদের জন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব।
সরকারের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। “শিক্ষক উন্নয়ন প্রকল্প” (Teacher Development Project) এর অধীনে শিক্ষকদের জন্য কারিকুলাম-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ২০২১ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো:
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (NCTB) প্রশিক্ষণ: NCTB শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যাতে তারা আধুনিক শিক্ষাদানের কৌশল শিখতে পারেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প: এই প্রকল্পের অধীনে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সকল শিক্ষককে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা।
UNICEF ও UNESCO সহযোগী প্রকল্প: এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করছে। UNICEF এর “School of 21st Century Teachers” প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন: অনেক শিক্ষকই প্রশিক্ষণ নিলেও দীর্ঘমেয়াদে তা ধরে রাখতে পারেন না। এটি রোধে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রাখা প্রয়োজন।আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কম থাকায় শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেতে অসুবিধা হয়। সর্বাপরি প্রশিক্ষণের মান নির্ধারণ ও উন্নয়নে কার্যকর মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকা জরুরি। প্রশিক্ষণের শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন
সরকার এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে শিক্ষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও এই বিষয়ে কাজ করছে।
১. অনলাইন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা: একটি সুসংহত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে শিক্ষকরা সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।
২. বিদেশি প্রশিক্ষণের সুযোগ: শিক্ষকদের জন্য বিদেশি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হতে পারে, যা তাদের বৈশ্বিক মানের সাথে পরিচিত করতে সাহায্য করবে।
৩. সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প: প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে তাদের দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে।
শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে পারে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের গুণগত মান উন্নত করবে না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখবে।