Picture of SuperAdmin

SuperAdmin

Video Editor

বাংলাদেশে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ: একটি বিতর্কিত বিষয়

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা জাতি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষাই এখন বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। একসময় শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম ছিল, কিন্তু এখন তা একটি পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষা থেকে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আর সুবিধাভোগী হচ্ছে বিত্তবান শ্রেণী। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ে ওঠার সাথে সাথে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাকে এমন একটি পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আজকের দিনে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় স্কুলে পড়াশোনার খরচ প্রতি বছর লাখ টাকার বেশি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও দেখা যায়, নামকরা কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। 

বাণিজ্যিকীকরণের কারণে উদ্ভূত সমস্যা

১. শিক্ষা বিভাজন: বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বিত্তবান পরিবারের শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, আর দরিদ্র পরিবারগুলো পিছিয়ে পড়ছে। ধনী শিক্ষার্থী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীর মাঝে এই বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে, যা সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে অন্তরায়।

২. গুণগতমানের অবনতি: অর্থনৈতিক লাভের দিকে মনোযোগী হয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে উদাসীন। শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা সুযোগ এবং পাঠক্রমের মান উন্নয়নে যথাযথ নজর দেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থা শিক্ষার মানের অবনতি ঘটাচ্ছে।

৩. আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা থেকে দূরে থাকা: উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার মাধ্যমে নিজস্ব মান বজায় রাখে, যেখানে বাংলাদেশের বাণিজ্যিকীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার সুযোগ ও বরাদ্দ কম। এই কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পিছিয়ে পড়ে।

৪. মেধাবী শিক্ষার্থীদের ক্ষতি: অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শুধুমাত্র অর্থের অভাবে উচ্চমানের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ, একজন মেধাবী ছাত্র, যার নাম হাসান, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করেও পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। এই ধরণের ঘটনা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর।

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণে পরিসংখ্যান

ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬০% শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে, এবং এর মধ্যে অনেকেই উচ্চ ফি এবং অন্যান্য শিক্ষাবিষয়ক খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০% পরিবারের মাসিক আয়ের ২৫-৩০% ব্যয় হয় শিক্ষাখাতে। 

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে যুক্তি

যদিও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে, তবে এর পক্ষে কিছু যুক্তিও রয়েছে। 

১. প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত উন্নতি: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নত প্রযুক্তি ও অবকাঠামো প্রয়োগ করা সহজ। উদাহরণস্বরূপ, অনেক বেসরকারি স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুম এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহজলভ্য নয়।

২. চাহিদা পূরণে সহায়ক: বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। তাই বেসরকারি খাতের বিকাশ শিক্ষাক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ কমিয়ে আনতে সহায়ক হয়। বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন চাহিদা পূরণ করতে পারে।

৩. বৈচিত্র্যময় শিক্ষার সুযোগ: বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কোর্স এবং স্পেশালাইজড প্রোগ্রাম চালু থাকে, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

করণীয়

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকে সীমিত করে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১. সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব।

২. আরও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: সরকারি পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো হলে, বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হ্রাস পাবে।

৩. সহযোগিতামূলক শিক্ষাবৃত্তি প্রদান: সুবিধাবঞ্চিত এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা উচিত।

৪. বৈশ্বিক মানের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন: সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম চালু করা উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা দেশে থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একটি বিতর্কিত বিষয় এবং এটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ এবং জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। শিক্ষার মৌলিক অধিকার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে বাণিজ্যিকীকরণের কুফল কমিয়ে, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

May you like -----