Education Insights

🌟️Get unlimited access to the best of ClickNews for less than $1/week

বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হলেও বেশিরভাগই সম্পূর্ণ শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, যা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। এই হার কমাতে হলে এর কারণগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ সমাধানমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণসমূহ

১. দারিদ্র্য: বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবার আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের পড়াশোনায় ব্যয় করতে পারেন না। দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ছেড়ে কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকতে হয়। যেমন, জামালপুরের রফিকের কথা বলা যেতে পারে, যিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালেই তার বাবার অসুস্থতার কারণে স্কুল ছেড়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে আসে। এই দারিদ্র্যই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম বড় কারণ।

২. পারিবারিক ও সামাজিক চাপে বাল্যবিবাহ: অনেক কিশোরী মেয়ে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০% মেয়ে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়, যা তাদের পড়াশোনার ইতি টানে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, এই সমস্যাটি আরও প্রকট।

৩. শিক্ষার মানের অভাব: অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, পাঠ্যক্রম যথাযথভাবে প্রণয়ন করা হয় না, এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে উদাসীনতা দেখা যায়। ফলে, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং পড়াশোনার চেয়ে কাজ করতে বেশি উৎসাহী হয়।

৪. বিদ্যালয়ের দূরত্ব ও পরিবহন সমস্যা: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। বিশেষ করে মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার পথে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকে, যা তাদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করে।

৫. কারিগরি শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাব: শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার অভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবন ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপন করতে পারে না। ফলে তাদের কাছে শিক্ষার মূল্যায়ন কমে যায় এবং ঝরে পড়ার হার বাড়ে।

 

শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পরিসংখ্যান

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ছিল প্রায় ১৭% এবং মাধ্যমিক স্তরে এই হার ৪০% এর কাছাকাছি। ইউনেস্কো জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্কুলে ভর্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪৫% মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছানোর আগেই ঝরে পড়ে। এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঝরে পড়া রোধে করণীয়

এই সমস্যার সমাধানে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম: দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে আরও উৎসাহী হবে।

২. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা: বাল্যবিবাহ রোধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা উচিত। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে হবে।

৩. শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার মান বাড়ানো যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে মনোযোগী করে তুলতে আকর্ষণীয় শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।

৪. কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করলে তারা জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপন করতে পারবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে।

৫. বিদ্যালয়ে আর্থিক সহায়তা ও প্রণোদনা: দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা বা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করলে তাদের শিক্ষাগ্রহণ সহজ হবে। এছাড়া, কৃতিত্বের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা প্রদান করলে তারা পড়াশোনায় উৎসাহিত হবে।

৬. মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা: বিদ্যালয়ের পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করে মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার বাড়ানো যেতে পারে।  

 

সফল উদাহরণ: বাংলাদেশের কিছু উদ্যোগ

বাংলাদেশে কয়েকটি উদ্যোগ ইতিমধ্যে সফল হয়েছে। যেমন, ‘স্টিপেন্ড প্রোগ্রাম’ বা বৃত্তি প্রকল্প দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া, ‘মেয়েদের জন্য সাইকেল বিতরণ কর্মসূচি’ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। 

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বাংলাদেশে একটি বহুমুখী সমস্যা, যার পেছনে রয়েছে দারিদ্র্য, সামাজিক সংস্কার, এবং শিক্ষার গুণগত মানের অভাব। এটি রোধ করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে দেশের উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *