Picture of SuperAdmin

SuperAdmin

Video Editor

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্ভাবনী উদ্যোগ: সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রতিককালে যেসব উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশের শিক্ষার্থীদের জীবন পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবু এসব উদ্যোগের কিছু চমৎকার সাফল্য যেমন আছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার গল্পও রয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতার এই মিশেলে একে বাংলাদেশের শিক্ষার সংস্কার যাত্রা বলা যেতে পারে। এই লেখায় উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হবে, যাতে আমরা বুঝতে পারি কোন উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর হতে পারে।

উদ্ভাবনী উদ্যোগের সূচনা: একটি গল্প

২০১০ সালের এক ঘটনার কথা ধরা যাক। ময়মনসিংহের ছোট্ট একটি গ্রামের স্কুলে পড়েন শাহেদ নামের এক মেধাবী ছাত্র। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে সে কখনো বিজ্ঞান বইয়ের বাহিরে যেতে পারেনি। ২০১১ সালে এই গ্রামের স্কুলে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট-নির্ভর শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। সেই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো শাহেদ একটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্ট দেখতে শুরু করে। এই উদ্যোগটি শাহেদের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীর দিগন্ত খুলে দেয় এবং শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। 

এই উদাহরণটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কেবল শিক্ষার সাধারণ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সুযোগকে প্রসারিত করা যায়।

সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো

বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কিছু উদ্ভাবনী উদ্যোগ বেশ সফল হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের নতুনভাবে শিখতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:

১. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম: ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে হাজারো বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে অডিও-ভিজ্যুয়াল কন্টেন্টের মাধ্যমে জানতে পারে। 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়েছে এবং প্রায় ৪৫% শিক্ষার্থী এই উদ্যোগের কারণে পরীক্ষার ফলাফলে উন্নতি করেছে।

২. মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ভিত্তিক শিক্ষা: করোনা মহামারির সময়ে যখন বিদ্যালয় বন্ধ ছিল, তখন শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দিতে কিছু উদ্ভাবনী অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়। “শিখব” ও “আমার পাঠশালা” এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০২০ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পাঠ নিয়েছে এবং এতে শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩. টেলিভিশন শিক্ষা প্রোগ্রাম: মহামারিকালীন সময়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকার “আমার ঘরে আমার স্কুল” নামে একটি অনুষ্ঠান চালু করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা টিভির মাধ্যমে নিয়মিত পাঠ নিতে পারত। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী এই অনুষ্ঠান থেকে উপকৃত হয়েছে এবং এটি তাদের পড়ালেখায় বাধা দূর করতে সহায়ক হয়েছে।

ব্যর্থতার গল্প: বাস্তবতার মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ

উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো যতই কার্যকর হোক না কেন, কিছু ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জের কারণে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়নি। উদাহরণস্বরূপ:

১. টেকনোলজি অ্যাক্সেসের সীমাবদ্ধতা: উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সহজে এগুলো ব্যবহার করতে পারেনি। ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে ডিজিটাল শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেনি।

২. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব: নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঠদান করার জন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু অনেক শিক্ষক এই ধরনের প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের উপযুক্তভাবে সহায়তা করতে সক্ষম হননি। এই অভাবের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ কমেছে এবং শিক্ষার মান কমেছে।

৩. অর্থায়নের অভাব: উদ্ভাবনী উদ্যোগ চালু করতে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে বড় অর্থায়ন প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে এই ধরনের উদ্যোগ চালু করার পর তা কার্যকরভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। 

৪. পাঠক্রমের সাথে মিল না থাকা: উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর মধ্যে অনেকগুলো উদ্যোগ মূল পাঠ্যক্রমের সাথে সহজে মিলেনি। উদাহরণস্বরূপ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিক্ষার উপকরণগুলোর সাথে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু প্রায়শই অসম্পূর্ণভাবে মেলে। এতে শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহে ভাটা পড়ে।

ভবিষ্যৎ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য পরামর্শ ও সম্ভাবনা

উদ্ভাবনী উদ্যোগের সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে শিখে ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও কার্যকরী করে তোলার কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো:

১. প্রযুক্তি সুবিধার সম্প্রসারণ: গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিজিটাল সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

২. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে আরও দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন।

৩. উদ্ভাবনী উদ্যোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা: শিক্ষাখাতে আরও অধিক অর্থায়ন নিশ্চিত করা গেলে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্ভাবনী উদ্যোগের সফলতা ও ব্যর্থতা আমাদেরকে শেখায় যে শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এর উন্নয়নের জন্য নতুন ধারণা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে অনেক সাফল্য যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার কারণেও ব্যর্থ হয়েছে। তবে যদি আমরা এই ব্যর্থতা থেকে শিখে এগিয়ে যাই, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে যা শিক্ষার্থীদের জীবনের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের দক্ষতা দিতে সক্ষম হবে।

May you like -----