বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে সচেতনতা তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়। তবে, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের অভাবে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পড়াশোনা শেষে সঠিক পেশা নির্ধারণ করতে অসুবিধায় পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও আগ্রহ অনুযায়ী সঠিক পেশা বেছে নিতে সাহায্য করে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং।
ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করার পরও তাদের পছন্দসই পেশা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। তারা প্রায়ই পরিবারের চাপে অথবা প্রচলিত পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক শিক্ষার্থী শুধু পরিবারের ইচ্ছায় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেষ্টা করে, যদিও তাদের প্রকৃত আগ্রহ এবং দক্ষতা অন্য কোনো ক্ষেত্রে থাকতে পারে। ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এই ক্ষেত্রে একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করে এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক পেশা নির্বাচন করতে সাহায্য করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এখনও খুবই সীমিত। বেশিরভাগ স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে, প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে পেশা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। এক জরিপ অনুযায়ী, ৮০% শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার সময় কী বিষয়ে পড়তে চায় এবং কেন পড়তে চায়, তা জানে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের নিজের শক্তি, দুর্বলতা, আগ্রহ, এবং লক্ষ্য সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে পেশা বেছে নেয়।
ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এর সুফল
১. সঠিক পেশা নির্বাচনে সাহায্য: ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং শিক্ষার্থীদের তাদের দক্ষতা, আগ্রহ, এবং লক্ষ্য অনুযায়ী সঠিক পেশা বেছে নিতে সাহায্য করে। একজন শিক্ষার্থী যদি তার প্রকৃত যোগ্যতা এবং আগ্রহ বুঝতে পারে, তাহলে সে আরও সফল হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রিয়াজ নামে একজন ছাত্র পড়াশোনায় ভাল হলেও তার শিল্পকলার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সে শিল্পকলা ও ডিজাইনের দিকেই ক্যারিয়ার গড়ার পরামর্শ পায় এবং আজ সে একজন সফল গ্রাফিক ডিজাইনার।
২. মানসিক চাপ ও হতাশা দূরীকরণ: প্রায়ই শিক্ষার্থীরা পেশা নিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে মানসিক চাপে ভোগে। একটি সঠিক ক্যারিয়ার পরিকল্পনা তাদের মানসিক চাপ দূর করতে সহায়ক হতে পারে। তারা তখন জানে যে কোন পথে গেলে তাদের জন্য সঠিক ও ফলপ্রসূ হবে।
৩. কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো: ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং শিক্ষার্থীদের শুধু পেশা বাছাইয়ে সাহায্য করে না, তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়। এ ধরনের পরামর্শ তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রণোদিত করে, যা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ায়।
শিক্ষার্থীদের পেশা নির্বাচনে সচেতনতা বৃদ্ধি কিভাবে সম্ভব?
১. ক্যারিয়ার মেলার আয়োজন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার মেলার আয়োজন করে বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করানো যেতে পারে। এখানে বিভিন্ন পেশার অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে পেশা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং চালু: প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং চালু করা প্রয়োজন, যেখানে অভিজ্ঞ পরামর্শকরা শিক্ষার্থীদের সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। কাউন্সেলরদের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের তাদের পছন্দ এবং দক্ষতা অনুযায়ী ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করা।
৩. পেশা সম্পর্কে সচেতনতামূলক কর্মশালা: ক্যারিয়ার গঠনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। এখানে বিভিন্ন পেশার বৈশিষ্ট্য, দক্ষতা, এবং প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
৪. অভিভাবকদের সচেতন করা: শিক্ষার্থীদের পেশা নির্বাচন করতে হলে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। অনেক সময় অভিভাবকদের চাপে পড়েই শিক্ষার্থীরা পছন্দের পেশা বেছে নিতে পারে না। অভিভাবকদের বুঝানো দরকার যে শিক্ষার্থীর আগ্রহ এবং দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে পেশা বেছে নেওয়া উচিত।
উদাহরণ ও পরিসংখ্যান
বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কানাডার প্রায় ৯০% শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেবা পায়, যা তাদের পেশাগত জীবনকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে সহায়ক। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং পেশাগত স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং পেশা সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরামর্শের অভাবে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই ভুল পেশা বেছে নেয়। ফলে, কর্মজীবনে সফলতা অর্জন করতে তারা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই, সঠিক পেশা নির্বাচন ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একটি সচেতন ও দক্ষ জাতি গঠনে এই উদ্যোগ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।