Education Insights

🌟️Get unlimited access to the best of ClickNews for less than $1/week

২১ শতকের বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, আর এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে, আধুনিক শিক্ষা কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতা বিকাশ এবং তাদেরকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই প্রস্তুতি কতটা কার্যকর এবং আমরা কি সত্যিই ২১ শতকের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনে প্রস্তুত?

আধুনিক শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজনীয়তা

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনা নয়, বরং বাস্তবজীবনের দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বর্তমান বিশ্বের শ্রমবাজারে ২১ শতকের যে দক্ষতাগুলোর প্রয়োজনীয়তা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে সৃজনশীল চিন্তা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, যোগাযোগ দক্ষতা, দলগত কাজ এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ২১ শতকের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতার ৬৫% আসবে নতুন ধরনের প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষতা থেকে। তাই দেশের শিক্ষার্থীদেরও এই দক্ষতাগুলো অর্জনে সহায়ক একটি শিক্ষা কাঠামো প্রয়োজন।

 আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২১ শতকের দক্ষতা বিকাশের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। যেমন:

১. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রচলন: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তুকে আরও জীবন্ত ও আকর্ষণীয় উপায়ে শিখতে পারছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ভিডিও, অডিও, এবং প্রেজেন্টেশন দেখে বিষয়বস্তু বুঝতে পারে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়।

২. বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াচ্ছে। ফলে তারা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধানে দক্ষতা অর্জন করছে।

৩. যোগাযোগ ও দলগত কাজের উপর গুরুত্ব: বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে দলগত কাজ এবং যোগাযোগমূলক কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করছে এবং যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশে সহায়ক হচ্ছে।

সফল উদাহরণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলা যায় ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে “প্রজেক্ট-ভিত্তিক শেখা” নামের একটি উদ্যোগের কথা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে একটি প্রকল্পের ওপর কাজ করে, যা তাদের মধ্যে দলগত কাজ ও নেতৃত্বের গুণাবলি বাড়াতে সাহায্য করে। 

তবে দেশের গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা এই ধরনের উদ্যোগগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের প্রায় ৬৫% স্কুলে ইন্টারনেট সুবিধা নেই, যা তাদের প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া, গ্রামীণ শিক্ষকদের অনেকেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিচালনা বা প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষার মতো উদ্যোগগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পান না।

সফল উদ্ভাবন এবং চ্যালেঞ্জসমূহ

আধুনিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনেক সফল উদ্ভাবন ঘটেছে, যেমন মোবাইল অ্যাপভিত্তিক শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বসেই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। “শিখবো” ও “আমার পাঠশালা” নামের অ্যাপগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫০% শিক্ষার্থী এই অ্যাপগুলো থেকে উপকৃত হয়েছে। 

তবে সমস্যা থেকে যায়, কারণ এই ধরনের উদ্ভাবন কেবল শহরকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে এসব অ্যাপ থেকে তারা সুবিধা নিতে পারছে না।

২১ শতকের দক্ষতা অর্জনে আমাদের প্রস্তুতির মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো:

১. প্রযুক্তি এবং সরঞ্জামের অভাব: শহরের বাইরের বিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ও ইন্টারনেট সুবিধার অভাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রাখছে।

২. শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি: শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষাক্রম পরিচালনায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না, ফলে তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গাইড করতে পারেন না।

৩. অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা: উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অর্থায়নের প্রয়োজন, যা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। 

৪. মানসিক চাপ এবং সিলেবাসের ভার: শিক্ষার্থীরা নানা পরীক্ষা ও পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার চাপে থাকে, যার ফলে তাদের সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তা প্রায়শই অবহেলিত হয়।

২১ শতকের দক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদের শিক্ষাক্রমকে আরও কার্যকরী করতে কিছু সুপারিশ রয়েছে:

১. প্রযুক্তির উন্নয়ন: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে, গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করে ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।

২. শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষার উপায় ও কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের আরও দক্ষ ও প্রাসঙ্গিক পাঠদান করতে সক্ষম হবেন।

৩. সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তা বিকাশে এমন পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে যা প্রজেক্ট-ভিত্তিক কাজ, গ্রুপ অ্যাকটিভিটি এবং দক্ষতা-ভিত্তিক শেখার মাধ্যমে তাদের প্রস্তুত করবে।

৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব: শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি বাড়াতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানে আরও সফল হবে।

বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষা কারিকুলাম এবং ২১ শতকের দক্ষতা অর্জনে আমরা কিছুটা এগিয়েছি, তবে আমাদের অনেক দূর যাওয়ার বাকি। শিক্ষাব্যবস্থার এই যাত্রা যত বেশি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষ শিক্ষক এবং বৈচিত্র্যময় শিক্ষাক্রম দিয়ে সমৃদ্ধ হবে, ততই শিক্ষার্থীরা সফলতার দিকে এগোতে পারবে। যদি আমরা সঠিকভাবে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারি, তবে বাংলাদেশে একটি আধুনিক, প্রযুক্তি-নির্ভর ও দক্ষতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *